মো. বাবু চৌধুরী | এবিএন নিউজ
ইফতারি প্রথা বন্ধ হোক, এই প্রথা যেন কোন বাবা-মার বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
দেশের বিভিন্ন জনপদে নানা ঐতিহ্য ও প্রথার প্রচলন আছে। যুগ যুগ ধরে স্থানীয়রা এসব প্রথা টিকিয়ে রেখেছেন বংশ পরম্পরায়। এরমধ্যে কিছু আছে ঐতিহ্যের অংশ হয়ে। আবার কিছু প্রথা গলার কাঁটার মতোই বিঁধে আছে। সহসা যা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
এই রমজানে তেমনই একটি প্রথা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। সেটি হলো মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানোর রেওয়াজ। এটি আবার যেনতেনভাবে করলেই হবে না। কারণ ইফতারের পরিমাণ, আইটেম ও বৈচিত্র্যের সাথে জড়িত থাকে উভয়পক্ষের মান-মর্যাদার প্রশ্ন।
এ কারণে রমজানের ২-৩ মাস আগে থেকেই অনেক বাবাকে চিন্তা করতে হয় কী করে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর টাকা জোগাড় করা যাবে। অনেক বাবা ইফতারের এই আয়োজনের জন্য নিজের গরু ছাগল এমনকি হাস মুরগিও বিক্রি করেন। সুদে টাকা এনে তা মেটাতে বছর পার করেছেন অনেকেই।
ইফতার শুধু মেয়ের বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছেলের শ্বশুড়বাড়ি থেকে যেদিন ইফতার আসবে সেদিন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেয়া হয়। সেই সাথে একটি নীরব প্রতিযোগিতা চলে- কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত বেশি আইটেমের ইফতার এলো। কে তার শ্বশুরবাড়ির ইফতার কয়শ মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালো।
যার শ্বশুরবাড়ি থেকে যত বেশি ইফতার আসে তার তত সুনাম। তেমনি যে মেয়ের বাবার সে সক্ষমতা কম, তিনি ইফতারি দিয়ে খুশি করতে না পারলে- অনেক ক্ষেত্রে কথা শুনতে হয়।
*একজন পিতা-মাতা একটি মেয়েকে তিল তিল করে আদর মায়া মমতা ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তোলেন। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী মেয়ে বিবাহযোগ্য হলে তুলে দিতে হয় অন্যের হাতে এটাই জাগতিক পৃথিবীর নিয়ম।
একটি মেয়েকে বিয়ে দিতে কম করে হলেও বর্তমানে সাধারণ মানুষের ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকা বা তার উর্ধে খরচ হয়, এই টাকার যোগানদাতা হয় বাবা নামক বটবৃক্ষ মানুষটি, বাবা কি করেন এটি মেয়ের শ্বশুর পক্ষের কোনো মাথাব্যথা নাই বললেই চলে। আমাদের সমাজে প্রথা নামক বহু ধরনের ভাইরাস রয়েছে ।
*এই মুহূর্তে সামনে রমজান উপলক্ষে ইতিমধ্যে ইফতারি বিতরণ প্রথা চালু রয়েছে যারা এই দিনে দেয়া-নেয়া তে বিশ্বাসী তাদের জন্য নিচের এই সামান্য গল্পটুকু।
একজন পিতা গত কিছুদিন আগে তার একমাত্র কন্যা কে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু আগামী ২ তারিখ থেকে রোজা তাই মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে এবং সামাজিক কুপ্রথার বলি হয়ে আজ ইফতারি সরঞ্জাম পাঠিয়েছে জামাইয়ের বাড়িতে প্রায় ২৫,০০০ টাকা খরচ করে।
- ইফতারে সরঞ্জাম সকালবেলায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
সন্ধ্যাবেলায় বাবার কাছে মেয়ের ফোন।
মেয়ে-বাবা কেমন আছেন?
বাবা- হ্যা মা ভালো। তুই ভালো আছিস ত?
মেয়েঃ-আছি বাবা ভালো।
বাবাঃ-এইভাবে বলছিস কেনো?
তোর শ্বশুর রা খুশি হয়েছে তো?
মেয়েঃ- ওরা কিছু বলেনি।
জেঠি শাশুড়ি বলেছে ইফতারি একটু কম হয়েছে।
বাবা- (তখন বাবার চোখের পানি টলটল করছিল)
আচ্ছা মা তুমি কিছু বলতে যেওনা।
মেয়ে- বাবা শুনো।
তুমি আমাদের বাড়িতে ঈদে কাপড় দিবে না…?
বাবা- হ্যা মা দিবো, কেনো?
মেয়ে- তুমি কাপড় দিওনা, খালা শাশুড়ি বলেছে কাপড় দিলে সবার পছন্দ হবে না, কাপড় না দিয়ে টাকা দিয়ে দিতে। ৩০,০০০ টাকা দিলে সবার নাকি হয়ে যাবে।
বাবা – আচ্ছা মা, তুই চিন্তা করিস না।
আমি এখন ও বেঁচে আছি।
(বাবার বুঝতে দেরী হয়নি, এতক্ষনে মেয়ের চোখের
জল গড়িয়ে পড়েছে)
মেয়ে- আচ্ছা বাবা, এখন রাখি।
বাবা- আচ্ছা মা, ভালো থাকিস কোন চিন্তা করিস না।
- মেয়েটির বাবা অতঃপর তার মায়ের সাথে কথা বলেন।
নতুন জামাই বাড়িতে মৌসুমী ফলমুল দিতে হবে।
তাতে ১০-১৫ হাজার টাকা দরকার।
ঈদের পরে আবার কোরবানি, মেয়ের বাড়িতে গরু দিতে হবে,গরুর যে দাম কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা তো লাগবেই। আবার নিজেদের জন্য ও একটা লাগবে। - এইখানে শেষ নয়, আরো রয়েছে মেয়ের বাড়িতে দেওয়ার বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন আয়োজন।
- এই সব চিন্তা করতে করতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন মেয়ের) বাবা । (মেয়ের) মা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলো, কিছু জবাব না দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন বাবা।
- বাবার মাথায় একটাই চিন্তা কাজ করছে।
টাকা! টাকা! টাকাই বুঝি দিবে মেয়ের সুখ?
এইভাবে রাত ১২ টায় হঠাৎ করেই বাবার বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে তিনি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন।
ওনার হাত-পা গুলো ও অকেজো হয়ে যাচ্চে।
হয়তো ওনার জীবনের অনেক স্বপ্ন অসমাপ্ত রয়ে যাবে। সেই চিন্তা গুলো ওনাকে আরো যন্ত্রনায় কাতর করে তুলছে।
হঠাৎ করেই যেন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেলেন বাবা নামক মানুষটি।
- এইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে কত বাবা-মা।
আর মা- বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অগনিত ছেলে মেয়ে। হয়তো অনেকে এখন ও জানে না, তাদের বাবা বা মায়ের মৃত্যুর রহস্য। এইভাবে প্রতিনিয়ত আমরা হারাচ্ছি আমাদের প্রিয় বাবা-মা কে । - আমাদের এই কু-প্রথা/প্রচলন কি পরিবর্তন হবে না ?
হচ্ছে না কেনো পরিবর্তন এই সভ্য সমাজে ?
হে জাতি জবাব দিতে পারবে কেন হচ্ছে না ??
হ্যা শহরে কিছুটা পরিবতর্ন হলেও গ্রামে ৯০% লোক এই কূ-প্রথা প্রচলনে হয়ে আছে আবদ্ধ ।
- জেগে উঠুক সকলের ঘুমন্ত বিবেক।
আর যেন কোনো বাবা-মা না হারিয়ে যায় এমন কুপ্রথার বলি হয়ে, ধ্বংস হোক এই সকল কুসংস্কৃার ।